ভিয়েতনামের জন্য 'শাপেবর' হবে করোনা?
করোনাভাইরাস মহামারির ফলে থমকে গেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে ব্যতিক্রম ভিয়েতনাম। করোনাভাইরাস যেন আশীর্বাদ হিসেবে এসেছে দেশটির জন্য। গত ডিসেম্বরে প্রতিবেশি চীনে ভাইরাসটি ধরা পড়ার পর এর লাগাম টানতে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়াসহ নানামুখী ব্যবস্থা নিয়ে করোনা মোকাবেলায় দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সফল দেশ এই ভিয়েতনামই। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড় করাতে সরকারি নানা উদ্যোগের পাশাপাশি একেবারে ব্যক্তিপর্যায় থেকে এগিয়ে আসছে দেশটির জনগণও।
ভিয়েতনামের অন্যতম আয়ের উৎস তৈরি পোশাক রফতানি খাত। এই খাত দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড হতে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বিখ্যাত সব ব্র্যান্ড কোম্পানি দক্ষিণ-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নতুন উৎপাদনকারী খুঁজছে। কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে করোনা মোকাবেলায় সফল ভিয়েতমান এখন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের কম্পানিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।
শুধু কি তাই? এই মহামারি শুরু হওয়ার পর অনেক কম্পানি চীন থেকে গুটিয়ে ভিয়েতনামে ছুটছে। তবে এটার পেছনে যে শুধুমাত্র করোনা মহামারির অবদান আছে; বিষয়টি তেমন নয়। এর আগে থেকে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধও ভিয়েতনামের দিকে ইউরোপ-আমেরিকার কম্পানিগুলোর ব্যবসা সরিয়ে নেয়ায় কাজ করেছে।
গন্তব্য বদলানোর নেপথ্যে হংকংভিত্তিক কোয়ালিটি কন্ট্রোল অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন পরিদর্শন সংস্থা কিমা বলেছে, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ক্রেতাদের হঠাৎ করেই দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় পরিদর্শন এবং অডিট বেড়ে গেছে। এ ধরনের পরিদর্শন এবং অডিট রিপোর্ট অনেক সময় কম্পানিগুলোকে নতুন স্থানে সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে করা হয়। গত দুই মাসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এবং ফিলিপাইনে পরিদর্শন এবং অডিট প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি বেড়েছে ৫২ শতাংশ; এই অঞ্চলে টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেলস ব্র্যান্ডের অন্যতম গন্তব্য বাংলাদেশ।
ইউরোপ আমেরিকার কম্পানিগুলোর এ ধরনের পরিদর্শন এবং অডিট বৃদ্ধি পায় চীনে করোনাভাইরাসের শনাক্ত হওয়ার পর। কম্পানিগুলোর স্থানান্তরিত হওয়ার এই চিন্তা করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের সময় থেকেই ছিল। আগামী নির্বাচনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে গেলেও যে এই যুদ্ধের অবসান ঘটবে এমন কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিতর্ক আছে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় দেশগুলোরও।
কম্পানিগুলো চীন থেকে সরে এসে ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ফিলিপাইন এবং ভারতে ঘাঁটি গড়ার চিন্তা করছে। এরই মধ্যে ভারত সরকার এই সুযোগ লুফে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশটির সরকার চীন থেকে সরে আসা ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের জন্য ৪ দশমিক ৬ হেক্টর জমি বরাদ্দ দিয়েছে। যেখানে প্রাথমিকভাবে শত শত মার্কিন কম্পানি তাদের উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন করতে যাচ্ছে।
তবে কম্পানিগুলোর বেশিরভাগই তাদের নতুন উৎপাদন গন্তব্য খুঁজছে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। জাপানের আর্থিক প্রতিষ্ঠান নমুরার এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইউরোপ এবং আমেরিকার কম্পানিগুলোর গন্তব্য এখনও পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই রয়ে গেছে।
নমুরা বলছে, চীন থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬টি কম্পানি তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যে ২৬টি ভিয়েতনামে, ১১টি তাইওয়ানে, থাইল্যান্ডে আটটি এবং ভারতে মাত্র তিনটি কম্পানি গেছে।
ভিয়েতনাম কেন পছন্দের শীর্ষে?
চিত্রঃ ভিয়েতনাম টেক্সটাইল (গুগল)
চীনে যখন করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয় তখন ভিয়েতনামের সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। একেবারে শুরুতেই ভাইরাসটি নির্মূল করার লক্ষ্যে সেই সময় ভিয়েতনাম সরকার জানায়, অর্থনীতির আগে মানুষের জীবনকে বাঁচানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। সেলক্ষ্যে বেশ কিছু কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
দেশটিতে জানুয়ারির শেষের দিকে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আক্রান্ত ও তাদের সংস্পর্শে আসা সবার জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ১৪ দিনের মধ্যে চীন সফর করেছেন এমন বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ভিয়েতনাম সরকার। দেশটিতে মাত্র ৩৩০ জন করোনায় আক্রান্ত হলেও প্রাণ যায়নি একজনেরও।
করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে ভিয়েতনাম সরকারের কৌশলের প্রশংসা দেশে এবং বিদেশে অনেকেই করছেন। ব্রিটেনের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউগভের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ ভিয়েতনামি বলেছেন- দেশের সরকার করোনা ভালোভাবে মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছে।
নজিরবিহীন উদ্যোগ।
এছাড়া পূর্ব-দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানে তৈরি পোশাক উৎপাদন ব্যয় খুবই কম। বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ভিয়েতনাম সরকার ট্যাক্স হ্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের ছাড় দিয়েছে। এসবও দেশটিতে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
করোনা সঙ্কট শুরুর পর দেশটির পোশাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে শ্রমিকরাও প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। শ্রমিকরা ঘোষণা দিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে ও নিজেদের স্বার্থে বর্তমানে অতিরিক্ত সময় কাজ করলেও সেজন্য আলাদা কোনও মজুরি তারা নেবেন না। এতে উৎপাদন যেমন বাড়বে তেমনই কমে আসবে উৎপাদন ব্যয়ও; বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মন জয়ে ভিয়েতনামি শ্রমিকদের অভিনব এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
করোনাভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে দেশটির অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছিল। তবে বর্তমানে সেই ধাক্কা কেটে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ভিয়েতনাম। বৃহস্পতিবার দেশটির সরকারী শুল্ক দফতরের এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে, মে মাসেই দেশটির এক হাজার কোটি ডলার অতিরিক্ত বাণিজ্য হয়েছে। যদিও গত বছর একই সময়ে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি ছিল এক হাজার ১৯০ কোটি ডলার।
করোনা মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি যখন নাকানি-চুবানি খাচ্ছে তখন ভিয়েতনামের বাণিজ্য বিস্ফোরণ ঘটছে। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের আশপাশে। করোনমুক্ত হওয়ায় এখন চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বিনিয়োগকারীরা চলে আসছেন ভিয়েতনামে।
পোশাক শিল্পসহ ভিয়েতনামের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভগুলো সামান্য ঝাঁকুনি খেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কম্পানিগুলো সাময়িক সময়ের জন্য তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল করায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভিয়েতনামের রফতানি। কিন্তু এই দূরাবস্থা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান,ইন্ডিয়া টুডে।
*রিক্যাপ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত
0 Comments